ইতিহাস-বিষয়ক আলোচনায় যুগের বিভাজন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ । আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক বৈশিষ্ট্যের ওপর ভিত্তি করে এ যুগ বিভাজন নির্ণয় করা হয়ে থাকে । ঐতিহাসিকগণ খ্রিষ্টপূর্ব পাঁচ শতক থেকে খ্রিষ্টীয় তেরো শতক পর্যন্ত সময়কালকে বাংলার ইতিহাসের প্রাচীন যুগ বলে মনে করেন । আবার কেউ কেউ খ্রিষ্টপূর্ব পাঁচ শতক থেকে খ্রিষ্টীয় ছয় শতক পর্যন্ত সময়কালকে আদি ঐতিহাসিক যুগ এবং খ্রিষ্টীয় সাত শতক থেকে তেরো শতক পর্যন্ত সময়কালকে প্রাক- মধ্যযুগ বলেও যুগ বিভাজন করে থাকেন ।
এই অধ্যায় শেষে আমরা -
♦ বাংলাদেশের ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য ও প্রভাব সম্পর্কে জানতে পারব
♦ প্রাচীন বাংলার তথ্য অনুসারে জনপদগুলোর গুরুত্ব ব্যাখ্যা করতে পারব
♦ প্রাচীন বাংলার ইতিহাস সম্পর্কে ধারণা লাভে জনপদগুলোর গুরুত্ব জানতে আগ্রহী হব ।
i ও ii
i ও iii
ii ও iii
i, ii, ও iii
শিলা শীতকালীন ছুটিতে মা-বাবার সাথে রাজশাহীর বরেন্দ্র জাদুঘর পরিদর্শনে যায়। সেখানে গিয়ে সে প্রাচীন নিদর্শনের সাথে পরিচিতি লাভ করে। এর মধ্যে বিশেষ করে ছিল পাথরের চাকতিতে খোদাই করা লিপি । সে জানতে পারে এটি ছিল বাংলাদেশে পাওয়া প্রাচীন শিলালিপি এবং সম্রাট অশোকের সময় এ লিপি উৎকীর্ণ করা হয়েছিল।
মাইশার মামা বাড়ি বগুড়ায় বেড়াতে যায়। বিকেলে মামা তাকে একটি ঐতিহাসিক স্থান দেখাতে নিয়ে যায় এবং বলেন এটি নগরীয় ধ্বংসাবশেষ। পণ্ডিতরা মনে করেন, এখানে চাকতিতে খোদাই করা যে লিপি পাওয়া গেছে এটি বাংলাদেশের প্রাচীনতম শিলালিপি।
সিমা সিলেটে জন্মগ্রহণ করলেও মায়ের চাকরির সুবাদে কুমিল্লার বসবাস করেছে। সে এ অঞ্চলের প্রাচীন ইতিহাস ও ঐতিহ্য সম্পর্কে নানা তথ্য আয়ন করে।
প্রাচীন এক আতির নামানুসারে বাংলায় এক জনপদের নামকরণ করা হয়। সাবিক তার নানার সাথে ঐ জনপদে বেড়াতে গিয়েছিল।
অনিক একটি টি-শার্ট গায়ে দিয়েছে। এতে লেখা আছে “হরিকেল, সমতট, বরেন্দ্র ও চন্দ্রদ্বীপ যাই ঘুরে আসি।”
রায়পুর ইউনিয়ন চেয়ারম্যান মুরাদের দুর্বলতার কারণে পার্শ্ববর্তী জয়পুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান এসহাক মিয়া রায়পুরের কিছু অংশ তাদের আওতায় নিয়ে নেয়। মুরাদের পরে রায়পুরের চেয়ারম্যান হয় শহিদ মিয়া। তিনি রায়পুর ইউনিয়নকে দুভাগে ভাগ করেন। কিন্তু ঐ সময়ে জয়পুর ইউনিয়নের মধ্যে জাতীয় চেতনার উদ্ভব ঘটে।
বাংলাদেশের ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য ও প্রভাব :
এশিয়া মহাদেশের দক্ষিণে বাংলাদেশের অবস্থান। প্রাচীনকাল থেকে অনেকবার বাংলাদেশের রাজনৈতিক পালাবদল ঘটেছে। ফলে এর সীমারেখারও অনেক পরিবর্তন হয়েছে। ইংরেজরা ভারতবর্ষ থেকে চলে যাবার পর ১৯৪৭ সালে বাংলা দুই ভাগে বিভক্ত হয়। এর পশ্চিমাংশ ভারত আর পূর্বাংশ পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হয়। পাকিস্তানের অন্তর্গত বাংলাদেশের নাম হয় প্রথমে পূর্ববাংলা ও পরে পূর্ব পাকিস্তান। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তান একটি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্রে পরিণত হয়। এ রাষ্ট্রের নতুন নাম হয় বাংলাদেশ।
বাংলাদেশের উত্তরে রয়েছে বিশাল হিমালয় পর্বতমালা, দক্ষিণে বঙ্গোপসাগরের বিশাল নীল জলরাশি। দক্ষিণ-পূর্বে মিয়ানমার ছাড়া সমগ্র দেশটির বাকি সীমারেখা ঘিরে রেখেছে ভারত। বাংলাদেশের মোট আয়তন ১,৪৭,৫৭০ বর্গকিলোমিটার। এর অধিকাংশ অঞ্চলই সমভুমি। অসংখ্য নদ-নদী আর খাল-বিল ছড়িয়ে আছে এদেশের বুকজুড়ে। মূল নদ-নদীগুলো হচ্ছে পদ্মা, যমুনা, ব্রহ্মপুত্র, মেঘনা, তিস্তা ও করতোয়া।
কোন দেশের মানুষের জীবনাচরণ ও ইতিহাসের ওপর সে দেশের ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্যের প্রভাব অপরিসীম । এ জন্যই পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষের জীবনধারা, আচার-আচরণে এত বৈচিত্র্য লক্ষ্য করা যায়। বাংলাদেশের বিশাল সমভূমি আর প্রচুর নদ-নদী থাকায় এদেশের যোগাযোগ ও মালামাল পরিবহনের একটি বড় মাধ্যম নদীপথ। বিদেশি আক্রমণ থেকে দেশকে রক্ষা করার জন্য নৌযুদ্ধে পারদর্শী হয়ে ওঠে বাংলার সৈন্যরা। পাশাপাশি উর্বর ভূমির কারণে কৃষিভিত্তিক সমাজও গড়ে ওঠে।
এখানকার আবহাওয়া নাতিশীতোষ্ণ। ভৌগোলিক পরিবেশ দেশবাসীকে কোমল আর শান্ত স্বভাবের করেছে। আবার ঋতুবৈচিত্র্যের কারণে ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের সাথে যুদ্ধ করতে হয় বাংলাদেশের মানুষকে, তাই তারা হয়ে ওঠে সংগ্রামী। ফলে মানুষের অধিকার রক্ষার জন্য যুগ যুগ ধরে সংগ্রাম করেছে। শুধু স্বভাব চরিত্র নয়, বাংলার অধিবাসীদের খাদ্য তালিকা, পোশাক, ঘর-বাড়ি সবকিছুই এদের ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্যের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে। বৈচিত্র্যময় এই প্রাকৃতিক অবস্থান প্রতিরক্ষার ক্ষেত্রেও বাংলার মানুষকে কিছুটা বাড়তি সুবিধা দিয়েছে। নদ-নদী এদেশকে বহুকাল আড়াল করে রেখেছিল বিদেশি শক্তির লোভাতুর দৃষ্টি থেকে। অধিকন্ত পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে ১১০০ মাইলের ভৌগোলিক দূরত্ব ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে বিরাট ভূমিকা পালন করে।
প্রাচীন যুগে বাংলা (বর্তমানের বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গ) এখনকার বাংলাদেশের মতো কোনো একক ও অখন্ড রাষ্ট্র বা রাজ্য ছিল না। বাংলার বিভিন্ন অংশ তখন ছোট ছোট অঞ্চলে বিভক্ত ছিল। আর প্রতিটি অঞ্চলের শাসক যার যার মতো শাসন করতেন। বাংলার এ অঞ্চলগুলোকে তখন সমষ্টিগতভাবে নাম দেয়া হয় 'জনপদ'।
জনপদ:
প্রাচীন যুগে বাংলা বৰ্তমান বাংলাদেশের মতো একক ও অখণ্ড ছিল না। সাম্রাজ্যভিত্তিক বা কেন্দ্রীয় শাসন শুরু হওয়ার আগে বাংলা ছোট ছোট অনেকগুলো অঞ্চলে বিভক্ত ও স্থানীয়ভাবে শাসিত হতো। প্রাচীন বাংলার জনবসতিপূর্ণ ও কৃষিনির্ভর এই ছোট ছোট অঞ্চলগুলোকেই বলা হয় জনপদ।
নিচে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য জনপদের বর্ণনা দেওয়া হলো :
পৌড়: 'গৌড়' নামটি সুপরিচিত হলেও প্রাচীনকালে ঠিক কোথায় পৌড় জনপদটি গড়ে উঠেছিল তা জানা যায়নি। তবে ষষ্ঠ শতকে পূর্ব বাংলার উত্তর অংশে গৌড় রাজ্য বলে একটি স্বাধীন রাজ্যের কথা জানা যায়। সপ্তম শতকে শশাঙ্ককে গৌড়রাজ বলা হতো। এ সময় পৌড়ের রাজধানী ছিল কর্ণসুবর্ণ। বর্তমান মুর্শিদাবাদ জেলায় ছিল এর অবস্থান। বাংলায় মুসলমানদের বিজয়ের কিছু আগে মালদহ জেলার লক্ষণাবতীকেও গৌড় বলা হতো।
বঙ্গ : 'বঙ্গ' একটি অতি প্রাচীন জনপদ। বর্তমান বাংলাদেশের পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব দিকে বঙ্গ জনপদ নামে একটি অঞ্চল গড়ে উঠেছিল। অনুমান করা হয়, এখানে 'বঙ্গ' বলে একটি জাতি বাস করতো। তাই জনপদটি পরিচিত হয় 'বঙ্গ' নামে। প্রাচীন শিলালিপিতে বঙ্গের দুইটি অঞ্চলের নাম পাওয়া যায়- একটি 'বিক্রমপুর', আর অন্যটি 'নাব্য' । বর্তমানে না বলে কোনো জায়গার অস্তিত্ব নেই। ধারণা করা হয়, ফরিদপুর, বাখেরগঞ্জ ও পটুয়াখালীর নিচু জলাভূমি এ নাব্য অঞ্চলের অন্তর্ভূক্ত ছিল। প্রাচীন বঙ্গ জনপদ ছিল খুব শক্তিশালী অঞ্চল। 'বঙ্গ' থেকে 'বাঙালি জাতির উৎপত্তি ঘটেছিল।
পুণ্ড্র : প্রাচীন বাংলার জনপদগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো পুণ্ড্র। বলা হয় যে, পুণ্ড্র বলে একটি জাতি এ জনপদ গড়ে তুলেছিল। বর্তমান বগুড়া, রংপুর, রাজশাহী ও দিনাজপুর অঞ্চল নিয়ে এ পুণ্ড্র জনপদটির সৃষ্টি হয়েছিল। পুণ্ড্রদের রাজ্যের রাজধানীর নাম ছিল পুণ্ড্রনগর। পরবর্তীকালে এর নাম হয় মহাস্থানগড়। মহাস্থানগড় প্রাচীন পুণ্ড্র নগরীর ধ্বংসাবশেষ বলে পণ্ডিতেরা মনে করেন। প্রাচীন সভ্যতার নিদর্শনের দিক দিয়ে পুত্রই ছিল প্রাচীন বাংলার সবচেয়ে সমৃদ্ধ জনপদ। পাথরের চাকতিতে খোদাই করা লিপি এখানে পাওয়া যায়। ধারণা করা হয়, বাংলাদেশে প্রাপ্ত এটিই প্রাচীনতম শিলালিপি ।
হরিকেল : সপ্তম শতকের লেখকরা হরিকেল নামে অপর একটি জনপদের বর্ণনা করেছেন। এ জনপদের অবস্থান ছিল বাংলার পূর্ব প্রান্তে । মনে করা হয়, আধুনিক সিলেট থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত এই জনপদ বিস্তৃত ছিল। সমতট : পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব বাংলায় বঙ্গের প্রতিবেশী জনপদ হিসেবে সমতটের অবস্থান। কেউ কেউ মনে করেন, সমতট বর্তমান কুমিল্লার প্রাচীন নাম। গঙ্গা-ভাগীরথীর পূর্ব তীর থেকে শুরু করে মেঘনার মোহনা পর্যন্ত সমুদ্রকূলবর্তী অঞ্চলকেই সম্ভবত বলা হতো সমতট। কুমিল্লা শহরের ১২ মাইল পশ্চিমে বড় কামতা এর রাজধানী ছিল। কুমিল্লার ময়নামতিতে কয়েকটি প্রাচীন নিদর্শনের সন্ধান পাওয়া গেছে। শালবন বিহার এদের অন্যতম ।
বরেন্দ্র : বরেন্দ্রী, বরেন্দ্র বা বরেন্দ্রভূমি নামে প্রাচীন বাংলায় অপর একটি জনপদের কথা জানা যায়। এটিও উত্তরবঙ্গের একটি জনপদ। অনুমান করা হয়, পুন্ড্রের একটি অংশ জুড়ে বরেন্দ্রর অবস্থান ছিল। বগুড়া, দিনাজপুর ও রাজশাহী জেলার অনেক অঞ্চল এবং সম্ভবত পাবনা জেলাজুড়ে বরেন্দ্র অঞ্চল বিস্তৃত ছিল ।
তাম্রলিপ্ত : হরিকেলের দক্ষিণে অবস্থিত ছিল তাম্রলিপ্ত জনপদ। বর্তমান মেদিনীপুর জেলার তমলুকই ছিল তাম্রলিপ্তের প্রাণকেন্দ্র। সপ্তম শতক থেকে এটি দণ্ডভুক্তি নামে পরিচিত হতে থাকে।
চন্দ্রদ্বীপ : প্রাচীন বাংলায় আরও একটি ক্ষুদ্র জনপদের নাম পাওয়া যায়। এটি হলো চন্দ্রদ্বীপ। বর্তমান বরিশাল জেলাই ছিল চন্দ্রদ্বীপের মূল ভূখণ্ড ও প্রাণকেন্দ্র। এ প্রাচীন জনপদটি বালেশ্বর ও মেঘনার মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থিত ছিল।
প্রাচীন বাংলার জনপদ থেকে আমরা তখনকার বাংলার ভৌগোলিক অবয়ব, সীমারেখা, রাজনৈতিক বৈশিষ্ট্য ইত্যাদি সম্পর্কে মোটামুটি ধারণা লাভ করতে পারি। প্রাচীন বাংলায় তখন কোনো রাজনৈতিক ঐক্য ছিল না। শক্তিশালী শাসকগণ তাদের আধিপত্য বিস্তারের মাধ্যমে একাধিক জনপদের শাসন ক্ষমতা লাভ করতেন।
Read more